নিন্দিত নন্দিত কাজী নজরুল : নাসির আহমেদ কাবুল


বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজারের উক্তিটির মতো vini, vidi, viciÑএলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ঝড়ের বেগে এসে বাঙালির হৃদয়ে তো বটেই, চিরায়ত বাংলা সাহিত্যে নিজের একটি নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে নিলেন। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণ-তূর্য’-এই শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে  শৃঙ্খলিত-নিপীড়িত বাঙালির জীবন ও সাহিত্য। 

‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত এক পত্রে মোহিতলাল মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘বহু কবিতা পড়িয়া  এত আনন্দ পাই নাই, এমন প্রশংসার আবেগ অনুভব করি নাই। বাংলা ভাষা যে এই কবির প্রাণের ভাষা হইতে পারিয়াছে, তাহার প্রতিভা যে সুন্দরী ও শক্তিশালিনী-এ কথায় সাহিত্য সৃষ্টিরপ্রেরণা যে তাহার মনোগৃহে সত্য জন্মলাভ করিয়াছে, তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ তাহার ভাব, ভাষা ও ছন্দ। আমি এ অবসরে বাংলার সরস্বতী ম-পে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছি এবং আমার বিশ্বাস প্রকৃত সাহিত্যমোদী বাঙালি পাঠক ও লেখক সাধারণের পক্ষ হইতে আমি এই সুখের কর্তব্য সম্পাদনের অগ্রসর হইয়াছি (মোসলেম ভারত, ভাদ্র ১৩২৭)।

কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদারের এ লেখা নজরুলকে এনে দেয় বুনিয়াদী স্বীকৃতি। আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। মাত্র দু-বছর সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যে তার অবস্থান প্রায় নির্দিষ্ট হয়ে যায়। নিজ জাতির বিশ্বাস ও ভরসা ক্রমশই তাকে আরও বেশি উদ্যমী ও একনিষ্ঠ করে তোলে। এ কারণেই বোধহয় ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় নজরুলকে ত্রিকালস্পর্শী ডাক দেবার জন্যে আহবান করে বলা হয়, জাতির মুক্তির লক্ষ্যে তিনি এমন স্বপ্ন দেখান, যেন পঙ্গুও হিমালয় অতিক্রম করতে পারে, মূক কথা বলতে পারে। ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তাঁর গান   গাইব।’ -সুভাষচন্দ্র বসুর এমন মন্তব্যই প্রমাণ করে নজরুল জাতির মুক্তির অনিবার্য কা-ারি  হয়ে উঠেছিলেন। মুসলিম ভারত পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব রাধাকান্ত রায় চৌধুরী প্রত্যাশা করেন, ‘ছন্দে-গানে কবি নজরুল যেন প্রাণের গান বাজান।’

অন্যদিকে, ‘সওগাত’ (মাঘ, ১৩২৭) পত্রিকায় লেখক আবুল কালাম মোহাম্মদ সামসুদ্দীন মন্তব্য করেন, কাজী নজরুল ইসলামের হাতেই প্রবর্তিত হবে বাংলা কবিতার নতুন ধারা। তাই স্বাগত নজরুল, ‘আমরা কাজী সাহেবকে সাদরে সাহিত্য আসরে অভিনন্দিত করি। তিনি কাব্যের মিথ্যা ও ভ-ামির পূর্ণমূর্তির উপরে কাব্যের সৌন্দর্যপূর্ণ ও সত্যমূর্তির প্রতিষ্ঠা করুন।’

বাংলা সাহিত্যে নজরুলের প্রতিষ্ঠা কারো দয়া কিংবা কোনো গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে নয়। লাভ-লোভ-মোহ-স্বার্থের বাইরে ছিল তার কলম। অন্যায়-অবিচার, অসত্য ও ভ-ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও আপোষহীন এক দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এই শিল্পীপুরুষ। প্রগতিশীল উদার মানবদরদী মননশীল এই শিল্পী ধর্মীয় সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি-কুসংস্কার, কৌলিন্যবোধ তথা সর্বপ্রকার অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক কোনো চিন্তা বা কর্মকে কখনই সমর্থন করেননি বা প্রশ্রয় দেননি তিনি। তার লেখায় সমানভাবে ঠাঁই পেয়েছে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। নজরুলই প্রথম লেখক যিনি ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিষবৃক্ষের শেকড়ে নির্মোহভাবে কুঠারাঘাত হানেন এবং ল-ভ- করে ফেলেন রক্ষণশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হিন্দু বা মুসলামান উভয়ের স্বার্থ-বলয়। একইসাথে আঘাত করেন মোল্লা-পুরুতের ব্যবসায়িক স্বার্থে। তার নিজের কথায় :

‘ধর্মের সত্যকে সওয়া যায় কিন্তু শাস্ত্র যুগে-যুগে অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলেই তার বিরুদ্ধে যুগে যুগে মানুষও বিদ্রোহ করেছে। হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায় কিন্তু তাদের টিকিত্ব ও দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়তো পা-িত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লত্ব! এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছ নিয়ে আজ এত চুলোচুলি!’

নজরুলের বিরুদ্ধে কঠিন ও কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তারই স্বধর্মের একশ্রেণির ধর্মান্ধরা। নজরুল বরাবরই একশ্রেণির মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী, লেখক ও ভক্ত পাঠকগোষ্ঠী পেয়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের মিলন মোহনায় দাঁড়িয়ে সেতুর ভূমিকা পালনকারী এই লেখকের বিরুদ্ধবাদীদের সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন এঁরাই। দুই ধর্মের যা কিছু মহান ও মানুষের জন্য কল্যাণকর এবং সর্বোপরি, দেশ ও জাতির মুক্তির প্রেরণার জন্য ব্যবহার্য সবকিছুই নজরুল তার গান-কবিতা-গল্পে ব্যবহার করেছেন পক্ষপাতহীনভাবে। 

ভারতীয় ঐতিহ্যের এই সাবলীল ব্যবহারকে ‘কুফরী কালাম’ বলে মন্তব্য করেছিলেন ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার সম্পাদক। এ পত্রিকায় (কার্তিক, ১৩২৯) মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ নামের একজন ‘লোকটা মুসলমান না শয়তান’ এই শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘নজরুল যথেষ্ট শক্তিশালী কবি হলেও মুসলমানদের গৌরব করার কিছুই নেই।’ কারণ ‘হিন্দুয়ানী মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ!’

তার বিস্ময়, ‘দুঃখের বিষয় অজ্ঞান যুবক এখন আপনাকে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিতেছে।’ নজরুলের এই সাহস আর কর্মের জন্যে একশ্রেণির মুসলমানকেই দায়ী করেন তিনি। তারা নজরুলকে বাহবা দিয়ে বুকের পাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তার মতে, ‘খোদাদ্রোহী নরাধম নাস্তিকদিগকেও পরাজিত করেছে। লোকটা শয়তানের পূর্ণাবতার।’ তার আক্ষেপ, ‘খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকিলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূলবিদ্ধ করা হইত বা উহার মু-ুপাত করা হইত নিশ্চয়।’

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নজরুল ‘ইন্দ্রপতন’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। প্রগাঢ় অনুভূতি প্রকাশের স্বার্থে, কবিতায় মহৎ ভাব আনয়নের জন্য রূপকার্থে আসে নবী প্রসঙ্গ। কা-জ্ঞানবর্জিত একশ্রেণির ধর্মানুরাগীরা তেলেবেগুনে জ্বলে  ওঠে এবং নিন্দার ঝড় তোলে চারদিকে। ‘মুসলিম জগৎ’ (আষাঢ়, ১৩৩২) পত্রিকার সম্পাদকীয়তে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানিয়ে বলা হয়, ‘উঃ একি স্বেচ্ছাচারিতা নজরুল! তোমাকে জিজ্ঞাসা করি কোন সাহসে তুমি এ হেন অগৌরবের আল্লার নবীর উপর বাণী প্রয়োগ করিয়াছ!’

‘ইসলামের শোণিত বিন্দুমাত্র কি তোমার শিরায় নাই, তোমার প্রাণে কি এতটুকু ভয় নাই।’ অভিশাপ করা হয়, ‘নজরুল তোমার লেখনিকে অভিসম্পাত, তোমার কবি প্রতিভাকে শতসহ¯্র ধিক্কার।’ পাশাপাশি সতর্কও করা হয়, ‘আপনারা তাহাকে সাবধান হইতে বলুন’। পরের মাসে ‘মুসলিম দর্পণ’ পত্রিকায় ‘ইসলাম  বৈরী মুসলমান কবি’ শিরোনামে এক নিবন্ধে নজরুলকে গুরুতর স্বেচ্ছাচারী, ধর্মজ্ঞানহীন ও বিবেকহীন বলে অভিযুক্ত করা হয়। অভিমত প্রকাশ করা হয়, ‘যথোচিত শাসিত করা সমাজের ক্ষেত্রে একটা কর্তব্য।’ শেষ মন্তব্য, ‘কবির ইহা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, ইসলামের এইরূপ অবমাননা করিলে খোদার গজব সত্ত্বরই নাজিল হইবে।’

নজরুলকে ঘিরে ‘মোহাম্মদী’ বনাম ‘সওগাত’ বিতর্ক সর্বজনবিদিত। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার প্রধান লক্ষ ছিল নজরুল-বিরোধিতা। এ জন্যে তাদের লেখকরা মরিয়া হয়ে কলম চালিয়েছে; শিল্প-নীতি বর্জিত এসব লেখায় কখনো কখনো রুচিহীন বিকারগ্রস্ত মানসিকতারও প্রকাশ ঘটে। ধর্মরক্ষার দোহাই ছিল ওদের লেখায়। এ পত্রিকায় (কার্তিক, ১৩৩৫) নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের বিদ্রোহীচেতনাকে ধর্মদ্রোহিতার সাথে তুলনা করে বলা হয়, ‘খোদাতালার প্রতি অতি জঘন্য ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করাই তাহার এই পুস্তকের প্রধান বিশেষত্ব।’ তাদের মতে, আজাজিলও এ ধরনের দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে না। এ যুবক আঘাত করেছে ইসলামের চরম ও পরম শিক্ষার মর্মমূলে। আল্লাহকে অমান্য করে বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করতে চায় কালী, দুর্গা ও সরস্বতীর পূজা। তাদের সিদ্ধান্ত, ‘সুতরাং বর্তমান যুগে তিনি যে এসলামের প্রধান শত্রু তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।’

নজরুল বাংলার মুসলমানদের আরাধ্য কবি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হিন্দু, বাকি অর্ধেক মুসলমান। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শক্তিশালী বাঙালি লেখক-চিন্তকের পাশাপাশি দাড় করানো যায় এমন একজনও মুসলমান লেখকের সন্ধান মেলে না নজরুলের আবির্ভাবের পূর্বে। মীর মশাররফ হোসেনের নাম উচ্চারণ করা যায় বটে, কিন্তু তার লেখা বাঙালির মুসলমানের সার্বিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না। 

একমাত্র নজরুলের লেখাতেই বাঙালি মুসলমানের সার্বিক চেতনার প্রতিফলন ঘটে। ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘মোহররম’, কোরবানী প্রভৃতি এবং অসংখ্য গানে সার্থক প্রতিফলন ঘটে ইসলামি ঐতিহ্য ও চেতনার। তাই লেখালেখির সূচনালগ্নেই নজরুল ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ফলে খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি নিন্দুকেরা। প্রতিটি অন্যায্য ও অযৌক্তিক আক্রমণের দাঁতভাঙা প্রত্যুত্তরও জুটে বিরুদ্ধবাদীদের। বিশেষত সওগাত দলের তরুণ লেখকরা কিছুতেই নজরুলের উপরে কোনো আক্রমণকে বিনা লড়াইয়ে ছেড়ে দিতেন না। অন্যদিকে কবির প্রতি প্রগতিশীল সুধীসমাজের আন্তরিক শ্রদ্ধার কমতি ছিল না। নজরুলের পক্ষ নিয়ে ‘সওগাত’ পত্রিকাটি যে দুঃসাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয়। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দিয়ে ‘সওগাত’ পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে আছে।

অন্যদিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘কবি নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন, সেটা শুধু তার নিজের স্বপ্ন নয়, সমগ্র বাঙ্গালী জাতির স্বপ্ন।’ বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘নিন্দা করাই যাদের উদ্দেশ্য তাদের আর কোনো ছল খুঁজতে হয় না। ...নইলে নজরুল ইসলামের গজল-গানগুলির প্যারোডি করতে নিশ্চয়ই তাদের হাত কাঁপতো।’ (প্রগতি,  চৈত্র, ১৩৩৪) ‘কালিকলম’ পত্রিকায় লিখেছিল, ‘এ পত্রিকা (শনিবারের চিঠি) যেন বাংলার সমাজ ও সাহিত্যের আদর্শ ঠিক করে দেবার আসরে নেমেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা কলমের জোরে নয়, গায়ের জোরে শক্তির পরীক্ষা দিতে হবে আগ্রহী।’

‘শনিবারের চিঠি’র আক্রমণ নজরুলের জন্য বরং শাপেবর হয়েছিল। বলা যায়, নিন্দুকবাহিনীর প্রবল তৎপরতার জন্যেই নজরুলের কবিখ্যাতির এত দ্রুত প্রসার ঘটেছিল। একসময় অবশ্য নিন্দুকদেরও বোধদয় হয়। স্বয়ং সজনীকান্ত দাসের উপলব্ধি, ‘বর্তমান মানুষটিকে ভালোবাসা যায়, সমালোচনা করা যায় না।’ একদিকে গোঁড়া মুসলমানদের আক্রমণ, অন্যদিকে নাক-উঁচা তথাকথিত বিশুদ্ধবাদী সাহিত্যিকদের আক্রমণ নজরুলকে সাময়িক সংকটের মুখে ফেলেছিল বটে, কিন্তু নজরুলের বিকাশ থেমে থাকেনি। জাতীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুল বলেছিলেন : 

“আমার বন্ধুরা যেমন পাল্লার এধারে প্রশংসার পর প্রশংসার ফুলপাত চড়িয়েছেন, অন্য পাল্লায় অ-বন্ধুর দল তেমনি নিন্দার পর নিন্দার ধুলো-বালি কাদা-মাটি চড়িয়েছেন এবং দুই তরফের সুবিবেচনার ফলে দুই ধারের পাল্লা এমন সমভার হয়ে উঠেছে, মাঝে থেকে ঠিক থেকে গেছি, এতটুকু টলাতে পারেনি।”

সর্বোপরি নজরুল তার কালে সর্বাধিক বিতর্কিত, অবহেলিত, সংবর্ধিত ও আলোচিত কবি। সত্যের পক্ষে মানবতার জন্য প্রথাগত বা প্রতিষ্ঠিত চিন্তা বা রীতির বিপক্ষে যারাই বলেছেন বা লিখেছেন, সেই সক্রেটিসের কাল হতে আজ অবধি দ-িত হতে হয়েছে। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। হিমালয়সম বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল ধার্মিক ও সাহিত্যিকরা এবং একই  সঙ্গে সরকার। কোনো প্রতিবন্ধকতাই নজরুলকে আটকে রাখতে পারেনি।

কাজী নজরুল ইসলামকে বার বার বিভিন্ন বিদ্রƒপ ও সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। তবে তিনি কখনো হোঁচট খাননি। তিনি চির বিদ্রোহী, নিন্দুক ও সমালোচকদেরও প্রতিহত করেছেন কটাক্ষকে মূল্য না দিয়ে।’

সেকালের ব্যতিক্রমধর্মী এক বাংলা সাহিত্যসাময়িকী পত্রিকার নাম ‘শনিবারের চিঠি’। বাংলা সাহিত্যে বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এক ব্যতিক্রমধর্মী সমালোচনামূলক সাহিত্য সৃষ্টিতে ‘শনিবারের চিঠি’ সমহিমায় ভাস্বর। ‘শনিবারের চিঠি’র অবিস¥রণীয় অবদান বাংলা সাহিত্যে মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

যোগানন্দ দাসের সম্পাদনায় ১৯২৪ সালে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসাবে ‘শনিবারের চিঠি’র আত্মপ্রকাশ। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক ও সম্পাদক রামানন্দ চট্রোপাধ্যায়ের পুত্র অশোক চট্রোপাধ্যায় ছিলেন সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’র অন্যতম সংগঠক। প্রথমাবস্থায় মাত্র সাতাশটি সংখ্যা প্রকাশের পর ‘শনিবারের চিঠি’র প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলেও ১৯২৮ সালে নীরোদ সি চৌধুরীর (যিনি পরবর্তীকালে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ব্যতিক্রমধর্মী লেখক হিসেবে বিশেষভাবে নন্দিত ও নিন্দিত হন) সম্পাদনায় মাসিক হিসাবে ‘শনিবারের চিঠি’ আবার বের হয়। ওই সালেই ‘শনিবারের চিঠি’ সম্পাদনায় দায়িত্ব সজনীকান্তের ওপর অর্পিত হয়। প্রথম পর্যায়ে এই দায়িত্ব তিনি ১৯৩১ সাল পর্যন্ত পালন করেন। ১৯৩২ সালে সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক হয়ে একটানা ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বহাল থাকেন। ১৯৩৮ সালে সজনীকান্ত দাস পুনরায় মাসিক ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটানা ওই দায়িত্বে ব্রতী থাকেন। দীর্ঘকাল সজনীকান্তের সম্পাদনায় ‘শনিবারের চিঠি’ প্রকাশিত হওয়ায় বাংলা সাহিত্যের শস্ত্র স্বরূপ ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক হিসাবে তিনিই মূলত বিবেচিত হয়ে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে সাপ্তাহিক হিসাবে ‘শনিবারের চিঠি’র আত্মপ্রকাশের পর পরই সজনীকান্ত ‘শনিবারের চিঠি’র সঙ্গে যুক্ত হন। অষ্টম সংখ্যায় ভাবকুমার ছদ্মনামে সজনী কান্তের কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতার শিরোনাম ‘আবাহন’। ‘শনিবারের চিঠি’ সম্পর্কে বলতে গেলে সজনীকান্তের কথা বেশি এসে যায়। পত্রিকাটি প্রকাশের প্রথম পর্যায় থেকে তিনি পত্রিকাটির সঙ্গে ওৎপ্রোতোভাবে জড়িয়ে পরেন।

শনিবারের চিঠিপ্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য দলের সমালোচনা করা। কিন্তু একপর্যায়ে উদ্দেশ্যের পরিবর্তন ঘটে যে সময় কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। শনিবারের চিঠি প্রকাশের প্রারম্ভকাল থেকেই নজরুলের কাব্য প্রতিভাকে ব্যঙ্গ করে বিভিন্ন ছদ্মনামে তার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন। 


নাসির আহমেদ কাবুল
কবি ও কথাসাহিত্যিক

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url